ইটভাটার দূষণ কমাতে ও বায়ুর মান উন্নত করতে কার্যকর সমাধান উদ্ভাবন হয়েছে বাংলাদেশেই। নতুন এই উদ্ভাবনের ফলে ইটভাটা থেকে কার্বন নির্গমণ ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে। জ্বালানি সাশ্রয় হয় ২৩ শতাংশ। আর সামাজিক-পরিবেশগত সুফল আর্থিক ব্যয়ের তুলনায় ৬৫ গুণ বেশি হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকী ‘সায়েন্স’-এ চলতি মে মাসেই এ গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশের ইটভাটামালিকেরা আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়াই পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি-সাশ্রয়ী কৌশল গ্রহণে আগ্রহী ও সক্ষম। এটি দেশের ইটভাটাশিল্পে দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যকর কৌশল নিয়ে পরিচালিত প্রথম গবেষণা।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, গ্রিনটেক নলেজ সলিউশনস ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব পাবলিক হেলথের (বিইউএসপিএইচ) গবেষকেরা ইট উৎপাদন শিল্পের জন্য এই নতুন কৌশল নিয়ে এই গবেষণা করেছেন।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সবখানে বায়ুদূষণে ইটভাটার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলা হয়। দেশের প্রায় সাত হাজার ইটভাটার মধ্যে অর্ধেকই অনুমোদনহীন। এসব ইটভাটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে পরিচালনাও দুরূহ বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে এ গবেষণাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের যতগুলো উৎস আছে, তার মধ্যে ইটভাটা বড় দূষক হিসেবে চিহ্নিত। এখন এ ধরনের গবেষণা এ উৎসের দূষণ কমাতে সহায়তা করতে পারে। তবে এ গবেষণাকে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গ্রহণ করতে হবে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে।’
কীভাবে হলো গবেষণা
এ গবেষণার আওতায় ২০২২-২৩ সালের ইট উৎপাদন মৌসুমে ২৭৬টি ইটভাটার মালিককে শিক্ষা উপকরণ, প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়। গবেষণা পরিচালিত হয় খুলনা বিভাগের ছয় জেলায়।
গবেষকদের একজন আইসিডিডিআরবির হেড অব এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ মো. মাহবুবুর রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছু সহজ কৌশল ব্যবহার করেছি। ইট বোঝাই ও পোড়ানোর উন্নত পদ্ধতি এবং কয়লার পাশাপাশি বায়োগ্যাস জ্বালানি যেমন কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়। এগুলো জ্বালানি সম্পূর্ণ পোড়াতে ও তাপের অপচয় রোধে সহায়ক। এর উদ্দেশ্য ছিল সহায়তার মাধ্যমে ভাটামালিকদের ইট উৎপাদনে একটি জ্বালানি–সাশ্রয়ী পদ্ধতি গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করা।’ আগে ইট পোড়ানোর জন্য ইট একেবারে ঠেসে দেওয়া হতো। একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে থাকত। এই ঘনত্ব কমানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
আবার চুল্লিতে কয়লা দিয়ে আধা ঘণ্টা বসে থাকতেন শ্রমিকেরা। গবেষকেরা দেখেন, এভাবে বিরতি দিলে কয়লা বেশি খরচ হয়। শুধু তা–ই নয়, কিছু অংশ পড়ে থাকে। তাই তাঁরা ধারাবাহিকভাবে কয়লা দেওয়ার প্রচেষ্টা নেন। এতে তাপের ধারাবাহিকতা থাকত। অল্প খরচে বেশি সময় ধরে ইট পুড়তে পারত।
বিভিন্ন ছিদ্র দিয়ে তাপ বের হয়ে আসার ফলে যেমন জ্বালানি খরচ বাড়ত, তেমনি তাপও কম উৎপাদিত হতো। সেসব ছিদ্র বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। যে মুখ দিয়ে ইট প্রবেশ করানো হয়, এর পরিধিও কমিয়ে ফেলা হয়। তখন দেখা যায়, তাপ বিভিন্ন জায়গা দিয়ে আর বের হচ্ছে না।
মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, এসব পদ্ধতি নেওয়ার ফলে কাবর্ন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ অনেকটাই কমে যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ইট উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। তবে এটি গ্রিনহাউস গ্যাস ও বায়ুদূষণের বড় উৎস। প্রচলিত পদ্ধতিতে কয়লা পুড়িয়ে ইট উৎপাদন করা হয়। এতে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই–অক্সাইড, সূক্ষ্ম বস্তুকণা বা পিএম ২.৫ ও অন্যান্য দূষিত পদার্থের নিঃসরণ হয়। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ইটভাটাগুলোতে যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই খাত মানবস্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশের জন্য গুরুতর হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ ইটভাটামালিক এই পরিবর্তনগুলো গ্রহণ করেন। এতে জ্বালানির ব্যবহারে ২৩ শতাংশ কমে এবং পরিবেশে কার্বন ডাই–অক্সাইড ও পিএম ২.৫–এর নির্গমণ ২০ শতাংশ কমে। পাশাপাশি কয়লা খরচ কমে এবং উচ্চ মানের ইট উৎপাদন বাড়ে। গবেষকেরা ধারণা করছেন, প্রতি টন কার্বন ডাই–অক্সাইডের নিঃসরণ কমানোর জন্য মাত্র ২ দশমিক ৮৫ ডলার খরচ হয়।
চুয়াডাঙ্গার ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো উন্নত ও সাশ্রয়ী কৌশল নিতে আমরা একটুও দ্বিধা করিনি। যে গবেষণা হয়েছে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেশের সবখানে এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই।’
গবেষণার প্রধান লেখক নিভা ব্রুকস বলেন, ‘আমাদের গবেষণার ফলাফল দেখায় যে ইটভাটামালিকেরা সহজ পরিবর্তন গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, যদি তারা সঠিক প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা পান এবং তা তাদের অর্থনৈতিক লাভের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।’
গবেষণায় বলা হয়েছে, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শ্রমিকেরা প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি ইট উৎপাদন করেন। ইট উৎপাদন দেশের বার্ষিক কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণের ১৭ শতাংশ ও পিএম ২.৫ নিঃসরণের ১১ শতাংশ এর জন্য দায়ী। বর্তমানে ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইনে জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। আবার স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য স্থাপনা থেকে দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে বলা হয়েছে। তবে আইনের এই বিধানগুলো খুব শক্তভাবে প্রয়োগ করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে অধিকাংশ ইটভাটাই অবৈধভাবে স্কুলের কাছাকাছি স্থাপিত হয়েছে।